আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই মহানবি (সা.) আদর্শ সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আত্মার পরিশুদ্ধি ছাড়া সব আমল বৃথা। বান্দার ইহকালীন-পরকালীন সাফল্য ও মুক্তি নির্ভর করে আত্মশুদ্ধির ওপর। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সেই সফলকাম, যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে এবং সেই ব্যর্থ, যে তার আত্মাকে কলুষিত করেছে’ (সুরা শামস: ৯-১০)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা মালের দিকে দেখেন না; বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে’ (মুসলিম: ২৫৬৪; মেশকাত: ৫৩১৪)। অন্য হাদিসে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন’ (বুখারি: ৫১৪৪, ৬০৬৬; মুসলিম: ২৫৬৪; তিরমিজি: ১১৩৪; নাসায়ি: ৩২৩৯)।
পার্থিব মোহ ত্যাগ
ইসলাম মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে উৎসাহিত করলেও দুনিয়ার মোহে অন্ধ হতে নিষেধ করে। কেননা দুনিয়ার মোহ কখনও শেষ হওয়ার নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বৃদ্ধদের অন্তর দুটি বিষয়ে যুবক থেকে যায়। পার্থিব জীবনের ভালোবাসা এবং দীর্ঘ আশা’ (সহিহ বুখারি: ৬৪২০)।
আর এই মোহই মানুষকে নানাবিদ অন্যায় কাজে লিপ্ত করে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের নিয়ে দারিদ্র্যের ভয় করি না। কিন্তু এ আশঙ্কা করি যে, তোমাদের ওপর দুনিয়া এমন প্রসারিত হয়ে পড়বে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর প্রসারিত হয়েছিল। আর তোমরাও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিল। আর তা তোমাদের বিনাশ করবে, যেমন তাদের বিনাশ করেছে’ (সহিহ বুখারি: ৩১৫৮)।
দুনিয়াকে চেনার চেষ্টা
আত্মশুদ্ধির জন্য দ্বিতীয় কাজ- পৃথিবী ও তার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে জানা। কেননা শয়তান ও প্রবৃত্তি দুনিয়াকে সুশোভিত করে তোলে। এই বিষয়ে সতর্ক করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের দীনকে ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছিল এবং পার্থিব জীবন যাদের প্রতারিত করেছিল। সুতরাং আজ আমি তাদের বিস্মৃত হব, যেভাবে তারা তাদের এই দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং যেভাবে তারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করেছিল’ (সুরা আরাফ: ৫১)।
পার্থিব জীবনের বাস্তবতা জানার উপায় হলো কোরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রতিটি কাজের কারণ ও পরিণতি বিশ্লেষণ করা এবং করণীয় নির্ধারণ করা। ঠিক যেভাবে নবি (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার আগ পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহর কাছ থেকে সরতে পারবে না। তার জীবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করেছে? তার যৌবনকাল কী কাজে বিনাশ করেছে? তার ধন-সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং তা কী কী খাতে খরচ করেছে? সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল সে মোতাবেক কী কী আমল করেছে?’ (সুনানে তিরমিজি: ২৪১৬)।
দীর্ঘ আশা পরিত্যাগ
আল্লাহ পথের সাধকরা যখন দুনিয়ার প্রকৃত রূপ দেখতে পাবে, তখন তারা পার্থিব জীবনের ব্যাপারে দীর্ঘ আশা পরিত্যাগ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুনিয়ায় কম উপার্জন করো যেন স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারো, পাপ কমিয়ে আনো যেন মৃত্যু সহজ হয়, তুমি তোমার পিতাকে কোথায় রেখে এসেছ তা খেয়াল করো। কেননা তোমার শিরা-উপশিরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে’ (মুসনাদে শিহাব: ৬৩৮)।
আল্লাহর ভয়ে গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা
সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা এবং ছোট-বড় গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য অন্যতম আমল। দুনিয়াতেও আল্লাহভীতির অসংখ্য পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে পবিত্র কোরআনে। তাছাড়া স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকিদের সঙ্গী হয়ে যান। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা পরহেজগার এবং যারা সৎকর্ম করে’ (সুরা নাহল: ১২৮)।
ছোট-বড় গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে আয়েশা! তুচ্ছ গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকো। কেননা উক্ত পাপগুলোর খোঁজ রাখার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে অনুসন্ধানকারী (ফেরেশতা) নিযুক্ত রয়েছে’ (ইবনে মাজাহ: ৪২৪৩; মেশকাত: ৫৩৫৬)। আনাস (রা.) বলেন, ‘(হে লোকসকল!) তোমরা এমন কাজ করো, যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুলের চাইতে সূক্ষ্ম। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জামানায় আমরা সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম’ (বুখারি: ৬৪৯২; মেশকাত: ৫৩৫৫।
আল্লাহর বিধান মানা ও পরকালকে স্মরণ করা
মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং মৃত্যু, কবর, হাশর, জাহান্নামকে স্মরণ করার মধ্যেই রয়েছে আত্মাকে কলুষমুক্ত রাখার সর্বোত্তম উপায়। তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কারের ঘোষণা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, তাদের জন্য তাদের রবের কাছে পুরস্কার আছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’ (সুরা বাকারা: ৬২)।
পরকালের স্মরণকারীরাই প্রকৃত অর্থে বুদ্ধিমান। এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, দুনিয়াতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি কারা? তিনি জবাব দিলেন, যারা মৃত্যুর কথা অধিক পরিমাণে স্মরণ করে এবং তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দুনিয়া-আখেরাতে তারাই সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরিহিত হবে’ (মুজামুল কাবির: ১৩৫৩৬)। সুতরাং পরকালের স্মরণ ছাড়া আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা কঠিন। এজন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের হিসেব-নিকেশের সময় আসন্ন, অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে’ (সুরা আম্বিয়া: ১)।